১০ কারণে ব্যতিক্রম এবারের হজ

প্রকাশিত: ১১:০৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৫, ২০২০

করোনাভাইরাসের কারণে পাল্টে গেছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও পৃথিবীর বহু বিধিবদ্ধ নিয়ম। সে ধারাবাহিকতায় বদলে গেছে এবারের হজের নিয়ম। চিরায়ত নিয়ম ও ঐতিহ্যের বিপরীতে নতুন কিছু নিয়ম ও বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে তাতে। এবারের হজের ব্যতিক্রম ১০টি দিক তুলে ধরা হলো।

এক. সীমিত হাজি:-
করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে সৌদি আরবে অবস্থানরত মুসলিমদের থেকে মাত্র ১০ হাজার জনকে হজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ বিদেশি এবং ৩০ শতাংশ সৌদি আরবের নাগরিক। ১৬০ দেশের নাগরিকের মধ্য থেকে এই মুসল্লিদের নির্বাচন করা হয়েছে। গত বছর প্রায় ২৫ লাখ হাজি হজের অনুমতি পেয়েছিলেন। যাঁদের মধ্যে প্রায় ১৯ লাখই ছিলেন বিদেশি।

দুই. কোয়ারেন্টিনে অবস্থান:-
১৯ জুলাই রবিবার সাত দিনের কোয়ারেন্টিন শুরু করেছেন হাজিরা। সাত দিনের কোয়ারেন্টিন শেষে ৩ জিলহজ মক্কায় এসে আরো চার দিন কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। ৮ জিলহজ মিনায় অবস্থানের মাধ্যমে শুরু হবে হজের মূল কার্যক্রম। মিনা, মুজদালিফা, আরাফার ময়দানে অবস্থান এবং সাফা-মারওয়ার সাঈ ও তাওয়াফের মাধ্যমে ১২ জিলহজ হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। এরপর আবারও কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে তাঁদের।

তিন. কঠোর স্বাস্থ্যবিধি:-
করোনাভাইরাসের কারণে হজের সময় কঠোর স্বাস্থ্যবিধি জারি করা হয়েছে। ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মতে, ১৯ জুলাই থেকে মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, হাজিদের সব গমনস্থলে স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন, হাত ধোয়া ও থুতু ফেলার ব্যবস্থা, সাফা-মারওয়ায় সাঈ ও তাওয়াফের সময় দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রাখা, প্রত্যেক গ্রুপ তাওয়াফ করার পর কাবা চত্বর পরিষ্কার করা, কাবা ঘর ও হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ না করা, মসজিদের কার্পেট পরিবর্তন, মসজিদ চত্বরে খাবার গ্রহণ না করা, হাজি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা, ফেস মাস্ক ব্যবহার, আরাফা ও মুজদালিফায় প্রতি ৫০ মিটারে সর্বোচ্চ ১০ হাজির অবস্থান, সর্বোচ্চ ৫০ হাজি একত্রে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন।

চার. নিজস্ব জিনিসপত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ:-
স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে এবার কোনো হাজি নিজস্ব জিনিসপত্র ব্যবহার করতে পারবেন না। সৌদি আরবের হজ ও ওমরা মন্ত্রণালয় নিবন্ধিত হজযাত্রীদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদান করবে এবং শুধু সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। হাজিদের প্রদত্ত জিনিসের মধ্যে আছে—চিপ লাগানো একটি স্মার্ট ব্রেসলেট, দুই সেট ইহরামের কাপড়, ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, জামারাতে নিক্ষেপের জন্য জীবাণুমুক্ত কঙ্কর, জুতা, ফোনের চার্জার, জায়নামাজ, জুতার ব্যাগ, হাতব্যাগ ও হজের বিধি-বিধানসহ প্রাসঙ্গিক বইপত্র ও স্বাস্থ্যবিধি সংবলিত হজ নির্দেশিকা। এই জিনিসপত্র কেবল হাজি নিজে ব্যবহার করতে পারবেন। পরস্পর আদান-প্রদান করতে পারবেন না।

পাঁচ. খাবার গ্রহণে নিয়ন্ত্রণ:-
হজযাত্রীরা এবার বাইরের কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করতে পারবেন না। সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহবিষয়ক মন্ত্রণালয় হাজিদের সব খাবার ও পানীয় সরবরাহ করবে এবং নির্ধারিত খাবারই গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া হাজিদের যাতায়াত করতে হবে নির্ধারিত বাসে। প্রতি ২০ হাজির জন্য একটি বাস নির্ধারণ করা হয়েছে।

ছয়. মিনায় তাঁবুতে অবস্থান নয়:-
চলতি বছরের হাজিরা মিনায় তাঁবুতে অবস্থান করবেন না; বরং নির্ধারিত ভবনে তাঁদের অবস্থান করতে হবে।

সাত. ব্যাংকের মাধ্যমে কোরবানি:-
কোনো হাজি এ বছর নিজে কোরবানির পশু ক্রয় বা জবাই করতে পারবেন না। হাজিরা নির্ধারিত ব্যাংকে টাকা জমা দেবেন এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাঁদের পক্ষ থেকে কোরবানি করা হবে।

আট. পাঁচ ভাষায় খুতবা অনুবাদ:-
প্রথমবারের মতো এ বছর হজের খুতবা পাঁচটি ভাষায় অনুবাদ করা হবে। ভাষাগুলো হলো—ইংরেজি, ইন্দোনেশিয়ান, উর্দু, ফরাসি ও ফার্সি।

নয়. বৃদ্ধদের যেতে বারণ:-
হজের ক্ষেত্রে সাধারণত বয়সের সীমাবদ্ধতা থাকে না। শিশু থেকে শতবর্ষী মানুষও হজের অনুমতি পায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাদের নিয়ে সংবাদও হয়। কিন্তু এবার হজের ক্ষেত্রে বয়সের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ৬৫-ঊর্ধ্ব ব্যক্তিদের এবার হজের অনুমতি দেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যাঁদের হৃদেরাগের মতো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েছে তাঁদের এ বছর হজের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

১০. সাধারণ মানুষের চলাচলে বিধি-নিষেধ:-হজের সময় (১৮ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত) মিনা, মুজদালিফা ও আরাফা অঞ্চলে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করলে ১০ হাজার রিয়াল জরিমানা করার ঘোষণা দিয়েছে সৌদি সরকার। এ ছাড়া ৯ ও ১০ জিলহজ কাবা চত্বরে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে কর্তৃপক্ষ।

সাধারণ সময় হজ যেমন হয়

সাধারণ সময়ে হজের দৃশ্য এবারের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়। প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি মানুষ হজ করার সুযোগ পায়। যাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ থাকে নারী হাজি। যেমন ২০১৬ সালে মোট ১৮ লাখ ৬২ হাজার ৯০৯ জন হাজির মধ্যে নারী হাজির সংখ্যা ছিল সাত লাখ ৮০ হাজার ৬৮১ জন। মিনায় হাজিদের অবস্থানের জন্য প্রায় ৫০ হাজার তাঁবু স্থাপন করা হয়। প্রতিবছর হাজিরা প্রায় আট লাখ পশু কোরবানি করে। আর হাজিদের জন্য সরবরাহ করা হয় ২০ মিলিয়ন লিটারের বেশি জমজমের পানি।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার আগে সাধারণ ফ্লু মোকাবেলায় হাজিদের টিকা দেওয়া হলেও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা বিষয়টি আগে কখনো ছিল না; বরং অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে কখনো কখনো পদদলিত হয়েও হাজিদের মারা যাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। সৌদি আরবের সরকার, বড় বড় কম্পানি ও মক্কা-মদিনার সাধারণ মানুষের মধ্যে হাজিদের উপহার দেওয়া ও আপ্যায়নের রীতি থাকলেও খাবার, যাতায়াত ও বাসস্থানের ব্যবস্থা হাজিদেরই করতে হয়। আর মক্কা-মদিনায় সাধারণ প্রবেশাধিকার থাকে সব মুসলিমের।